জাতীয়করণের জন্য জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র মাদরাসার যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে জালিয়াতি করে স্থাপন করা দুটি মাদরাসার নামও রয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে কাগজপত্র জালিয়াতি করে জাতীয়করণের তালিকায় নাম উঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের ডুবানুচী গ্রামে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসা। এটি ১৯৯৪ সালে দাখিল পর্যন্ত পাঠদানের একাডেমিক স্বীকৃতি পায় এবং নাম হয় ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদরাসা। কিন্তু ২০১৮ সালে এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের খারুয়া গ্রামে হুবহু একই নামে আরেকটি মাদরাসা গড়ে তোলে চক্রটি।
অপরদিকে, উপজেলার পঞ্চগড় ইউনিয়নের শুরিভিটা গ্রামে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসা। প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে দাখিল পর্যন্ত ক্লাস চালুর স্বীকৃতি পায়। তখন নাম দেয়া হয় শুরিভিটা দাখিল মাদরাসা। জালিয়াত চক্র ২০১৯ সালে এ মাদরাসা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের বন্দেরপাড়া গ্রামে একই নামের মাদরাসা স্থাপন করে।
নতুন কোনো এবতেদায়ী প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণের তালিকায় স্থান পাওয়ার সুযোগ না থাকায় পুরোনো মাদরাসার নাম ব্যবহার করার কৌশল নেয় প্রতারক চক্রটি। তারা বিতর্ক এড়ানোর জন্য নতুন করে স্থাপন করা মাদরাসায় কোনো নামফলক স্থাপন করেনি। রাস্তার পাশে ফসলি জমিতে ছোট্ট করে টিন দিয়ে তৈরি করেছে ঘর। এখানে কোনো ক্লাস হয় না। শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থী কারও দেখাও পাওয়া যায়নি।
ভুয়া মাদরাসা দুটির পক্ষে যেসব কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশই জাল। জমি রেজিস্ট্রির দলিলটিও জাল। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মাদরাসা দুটির প্রতিষ্ঠাকাল দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সাল। পুরনো পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কারসাজি করে দেয়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ। প্রতি শিক্ষকের কাছে নেয়া হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা।
এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তারা ব্যানবেইসে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করেছে। মাদরাসার ভবনে ছয়টি আধাপাকা কক্ষ থাকার কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে একটি তিন কক্ষের টিনশেড ও টিনের বেড়ার ঘর ছাড়া কিছু দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেটিও কেবল কাগজে কলমে।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো কাগজপত্র যাচাই না করেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক ও সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিমাংশু কুমার রায় সিংহ ব্যানবেইসে তথ্য প্রেরণের কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। ভুয়া কাগজপত্রের ওপর ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র।
মাদরাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে কোনো একাডেমিক কার্যক্রম না থাকলেও এবার ওই দুটি মাদরাসা থেকে ১৬ জন করে শিক্ষার্থীর তালিকা এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার জন্য জমা দেয়া হয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার প্রত্যয়ন পেয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস ওই দুই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ডিআর জমা নিয়েছে।
কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরে আলম বলেন, ‘আমরা জানি না কীভাবে কোথা থেকে মাদরাসা দুটি হলো। মাদরাসার নামগুলোও কারা ঠিক করল তাও আমাদের জানা নেই। খারুয়াগ্রামের ফজল হক ও বন্দেরপাড়ার মিজানুর মাদরাসা দুটি চালু করেছে। ২০১৮ সালে হয়েছে খারুয়াগ্রামেরটা আর ২০১৯ সালে হয়েছে বন্দেরপাড়ার মাদরাসাটি।’
স্থানীয় চেয়ারম্যান মোজাহার আলী বলেন, ‘এক-দুই বছর আগে মাদরাসা দুটির ঘর তোলা হয়। এর আগে কখনও মাদরাসা দুটির অস্তিত্ব ছিল না। মাদরাসা দুটিতে যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেই নামে আমাদের এলাকায় কোনো জায়গা বা ব্যক্তির নাম নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। সরকারিভাবে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সঠিক নয়।’
তবে নতুন প্রতিষ্ঠিত ডুবানুচী মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, ‘মাদরাসাটি অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত। তবে গত বছর থেকে এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।’
১৯৬৫ সালের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা কেন ২০১৯ সালে প্রথম এবতেদায়ীতে অংশ নিল? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
মাদরাসার নামের বিষয়ে বলেন, ‘মাদরাসার আশপাশের ওইটুকু জায়গাকে আমরা ডুবানুচী বলি।’
মাদরাসাটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফজল হক জানান, ২০১৮ সালে মাদরাসা করার জন্য জমি দেন তিনি। মাদরাসার নাম জানা নেই তার। তার এক ছেলেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এখানে চাকরি দেয়া হয়েছে। আরেক ছেলে অন্য মাদরাসাটির প্রধান শিক্ষক। জয়নুল নামে এক ব্যক্তি মাদরাসা দুটি স্থাপনে সহযোগিতা করছেন। তিনিই দুটি মাদরাসার কাগজপত্র তৈরি থেকে শুরু করে দৌড় ঝাপ সবকিছু করছেন।
নতুন শুরিভিটা মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, শুরি নামে এক লোক ছিল, তার নামে এই মাদরাসা হয়েছে। একই নামে একাধিক মাদরাসা থাকতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে সাতমেরা ইউনিয়নের আসল ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মাদরাসার নাম নকল করে অন্য এলাকায় স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন খবর শুনে আমরা সত্যিই বিস্মিত। প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসার নাম জালিয়াতি করে কীভাবে তারা মাদরাসা স্থাপন করতে পারে আমাদের মাথায় আসে না। আমরা সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাই যেন বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
পঞ্চগড় ইউনিয়নের শুরিভিটা দাখিল মাদরাসার সুপার মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মাদরাসার নাম জালিয়াতি করে কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের একটি গ্রামে স্বতন্ত্র মাদরাসা করা হয়েছে বলে শুনেছি। তারা এত বড় জালিয়াতি করল কিন্তু কেউ বিষয়টি টের পেল না এটিই বড় আশ্চর্যের বিষয়।’
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘এসব বিষয় দেখে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। আমরা শুধু উপবৃত্তি ও পরীক্ষার বিষয়টি দেখি। আমাদের কাজের চাপ থাকায় স্বতন্ত্র মাদরাসাগুলো ভালো করে পরিদর্শনের সুযোগ হয় না।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, ‘আমরা ওই মাদরাসাগুলোর কাগজপত্র চেয়েছিলাম। একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে আরেকটি এখনও দেয়নি। কাগজপত্র পেলেই তা যাচাই করে দেখা হবে। তদন্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষা দিতে পারে তাই আমি প্রত্যয়ন দিয়েছি।
তবে ব্যানবেইসে ভুল তথ্য প্রেরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতার বলেন, ‘স্বতন্ত্র মাদরাসাগুলোর বিষয়ে মূল ভূমিকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। তারা যে তথ্য দেন আমরা সেগুলো পাঠিয়ে দেই মাত্র।’
এ নিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ হোসেনের বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেব। কোনো অনিয়ম এবং জালিয়াতি প্রমাণিত হলে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র মাদরাসার যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে পাঠানো হয়েছে। জালিয়াতি করার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।’